ফন্ডারি ফরটি সেভেন
অস্ত্র যদি হয় অলংকার, তবে কেমন হবে ব্যাপারটা? অবাক হওয়ার মতো হলেও এমনটাই ঘটেছে। মরণাস্ত্রকে ফ্যাশন অনুষঙ্গে পরিণত করার এক মহান প্রচেষ্টা
পৃথিবীর সৌন্দর্যকে মলিন করে দেয়ার বড় কারণগুলোর একটি হলো যুদ্ধ । নিসর্গ, শান্তি, শিশু যা কিছু সুন্দর সবই বিনাশ করে দেয় এটি। যুদ্ধক্ষেত্রে শক্তি বাড়াতে, আরো বিভীষিকাময় করে তুলতে যেখানে তৈরি হচ্ছে নিত্য নতুন অস্ত্র সেখানে একজন ঠিক করলেন এই মরণাস্ত্রকেই তিনি পরিণত করবেন নিষ্কলুস সৌন্দর্যে । পিটার থুম । এই অভিনব কর্মের স্বপ্নদ্রষ্টা। যিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন যুদ্ধের বিভীষিকা আর অনুভব করেছেন অস্ত্রের নিষ্ঠুরতাকে কোমল রূপান্তরের প্রয়োজনীয়তা।
ফন্ডারি ফরটি সেভেনের জন্ম
দ্য অ্যাভটোমেট কালাশনিকভ, মডেল ১৯৪৭। সাধারণত একে ফরটি সেভেন নামেই পরিচিত। পৃথিবীর নামকরা আগ্নেয়াস্ত্র । যা আফ্রিকায় চরম সংঘাতের চিহ্নে পারিণত হয়েছে কোল্ড ওয়্যারের পর থেকে। এমনকি শিশু সৈনিকরাও এটি হাতে পেলে হয়ে ওঠে নৃশংস। প্রতি বছর এই মরণঘাতী অস্ত্র ঘটিয়ে চলেছে অসংখ্য মৃত্যু। যুদ্ধ নয় শান্তি, মানুষকে এই মন্ত্রে উৎসাহিত করতে পিটার থুম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ফন্ডারি ফরটি সেভেন। একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে একে ফরটি সেভেন সরিয়ে , তার ভোল পালটে নেন দুর্লভ ও চমৎকার সব অ্যাকসেসরিজে। ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোতে থাকাকালীন বেশুমার মৃত্যু আর সহিংসতা তাকে ক্ষুদ্ধ করে তোলে। তখনই তিনি সিদ্ধান্ত নেন এমন কিছু করা দরকার যা মানুষকে রক্তাক্ত না করে অলঙ্কৃত করবে। তাঁর সাথে যোগ দেন জন জ্যাপলস্কি। প্রতিষ্ঠানটির সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তাঁরা একে ফরটি সেভেনের মতো সর্বাধিক প্রচলিত মরণাস্ত্রকে ধ্বংস করে পরিধানযোগ্য সৃষ্টিতে রূপান্তরের মহান উদ্যোগ হাতে নেন। আফ্রিকার নৃশংস কালো অধ্যায়কে বিনাশ করে দিতে জন্ম হয় ফন্ডারি ফরটি সেভেনের।
ফন্ডারি ফরটি সেভেনের শুরু
ফ্যাশন যে মানুষের কল্যাণে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখতে পারে ফন্ডারি ফরটি সেভেন তার প্রমাণ। একে ফরটি সেভেনের মতো ভয়ংকর অস্ত্র যা হত্যার বদলে এনে দেবে সৌন্দর্য্য। পিটার থুম ২০১০ সাল থেকে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো হতে বাজেয়াপ্ত একে ফরটি সেভেন ক্রয় করতে শুরু করে, সেগুলোর পার্টস থেকে জুয়েলারি তৈরির জন্য। রূপান্তর প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য বাজেয়াপ্ত রাইফেলগুলোকে ধ্বংস করা হয়। গান মেটালের সাথে আঠারো ক্যারেটের হোয়াইট ও ইয়েলো গোল্ডের মতো মূল্যবান ধাতু মিশিয়ে তৈরি হয় একেকটি পরিধারযোগ্য শিল্প । বিশেষভাবে উল্লেখের বিষয়টি হলো থুম ফন্ডারি ফরটি সেভেনকে ব্যবসার বাইরে রেখেছেন। এটি পুরোপুরি অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠান। এর প্রত্যেকটি পণ্যের বিক্রিত অর্থ জমা হয় ফন্ডারি ফরটি সেভেনের তহবিলে, আরো অস্ত্র ধ্বংস করার কাজে ব্যবহারের জন্য।
মেয়েদের জন্য প্রথম লাইন
এতে সহযোগী হিসেবে যুক্ত হয়েছেন মাস্টার ক্র্যাফটম্যান রোল্যান্ড আইটেন, ম্যাকিানিক্সের প্রতি যার রয়েছে প্রবল আগ্রহ, বিশ্বখ্যাত ডিজাইনার ফিলিপ ক্র্যাঙ্গি ও জেমস দে গিভেন্সি। থুম মনে করেন তাদের সৃষ্টিশীল দৃষ্টিভঙ্গি ফন্ডারি ফরটি সেভেনের কালেকশনকে আরো সমৃদ্ধ করবে। এরপর জেমস দে গিভেন্সি তৈরি করেছেন ফনিক্স কালেকশন। এই প্রথম কেবল মেয়েদের জন্য লাইন তৈরি করলো ফন্ডারি ফরটি সেভেন। যা ডিমের আকৃতি প্রাণিত, উদীয়মান সম্ভাবনা, মৌলিক সৌন্দর্য্য ও নবজন্মের প্রতীক হিসেবে। জেমসের এই সৃষ্টি ফন্ডারি ফরটি সেভেনের লক্ষ্যকে মূর্ত করে তুলেছিলো। একে ফরটি সেভেন স্টিল, টেকসই আঠারো ক্যারেট রোজ গোল্ড, প্ল্যাটিনাম ও সংঘাতমুক্ত হীরা সমন্বিত দশটি আইটেমের সীমিত সংস্করণটির মাধ্যমে তা সম্ভব হয়েছিলো।
খ্যাতনামা এই ডিজাইনার চেয়েছেন কালেকশনটির মাধ্যমে লোকজনকে একে ফরটি সেভেন দেখার সুযোগ করে দিতে। তিনি চেয়েছেন, যারা এটি পরবেন তারা অনুভব করুন মানুষের কল্যাণের অংশ হতে পারার সুখানুভূতি। সাথে এও জানুক কীভাবে তারা এই মহৎ কাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন, মানুষঘাতী অস্ত্র কীভাবে মানবিক ফ্যাশন অনুষঙ্গ হয়ে উঠছে। স্বাভাবিক ভাবেই জুয়েলারিগুলো বেশ দামী। তবে এটি জেনে যে কেউ সুখী হবেন যে, একেকটি পিস একটি মরণাস্ত্র ধাবংস করেছে। একটি ভয়ানক রাইফেল ঘড়ি হয়ে আপনার কব্জিতে, কিংবা আপনার আঙ্গুলে শোভা বাড়াচ্ছে। মানুষ হত্যার কাজে ব্যবহৃত না হয়ে একটি অস্ত্র আপনার প্রেয়শির কানে দুল হয়ে দুলছে। অথবা মানুষকে রক্তাক্ত না করে একটি রাইফেল কলম হয়ে লিখছে। চমৎকার না!
ফন্ডারি ফরটি সেভেনের সিইও পিটার থুম মনে করেন, প্রত্যেকটি পিস চ্যালেঞ্জে পরিণত হবে যদিনা মূল্য এবং বোধের পূর্ব ধারণার রূপান্তর না ঘটে। যেখানে প্রতিষ্ঠারটির লক্ষ্য মানুষঘাতী অস্ত্র ধ্বংসের মাধ্যমে আফ্রিকায় সহিংসতা বন্ধ করা। একটি স্টিল, ডায়মন্ড, আঠারো ক্যারেট রোজ গোল্ড ও প্ল্যাটিনাম রিং তৈরিতে ধ্বংস হয় পনের থেকে বিশটি মরণাস্ত্র ।যার প্রচলিত মূল্য একত্রিশ হাজার পাউন্ড। একে ফরটি সেভেন থেকে তৈরি হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দামী কাফলিঙ্ক। এক জোড়া কাফলিঙ্ক তৈরিতে ব্যবহৃত হয় একে ফরটি সেভেনের মূল উপাদান। এর সাথে অন্য কোনো উপাদান মেশানো হয়না। তাই কাফলিঙ্ক তৈরিতে বেশি রাইফেল ধ্বংস হয়। সুতরাং আশা করাই যায় ফন্ডারি ফরটি সেভেন তার লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে। মজার ব্যাপার হলো প্রত্যেকটি পণ্যই স্বতন্ত্র এবং কোনটির দ্বিতীয় পিস তৈরি হয়না আর প্রতিটি জুয়েলারি ও অ্যাক্সেসরিজ যে রাইফেলেটি থেকে তৈরি হয়েছে তার ক্রমিক নম্বর দেয়া থাকে। যা স্মরণ করিয়ে দেবে মৃত্যুকে, ধ্বংসকে।
প্রতিষ্ঠাতা পিটার থুম এবং সহ-প্রতিষ্ঠাতা জন জ্যাপলষ্কি আফ্রিকার বিস্তির্ণ এলাকা ঘুরে দেখেছেন এই ধ্বংসাত্বক রাইফেলের প্রভাব। এমনকি এটি তৈরি করছে প্রচুর শিশুসৈন্য। সেখানকার ভয়বহ ও মর্মান্তিক পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে সেখানে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তাই তারা একটি এসজিওর সাথে পার্টনারশিপে অফ্রিকায় কাজ শুরু করে দেন। থুম তার বৃহৎ পরিকল্পনার আলোকে বলেছিলেন- ‘একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার পর সেটি তার উদ্যোম আর নির্দিষ্ট কিছু সাফল্য নিয়েই বেঁচে থাকবে। ক্রমাগত এটি একে ফরটি সেভেন ও অন্যান্য অ্যাসল্ট রাইফেল ধ্বংস করে চলেছে। তাই আশা করাই যায় প্রতিষ্ঠানটি তার লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়েছে। পিটার থুম চেয়েছেন এমন কিছু তৈরি করতে যা মানুষ আগে দেখেনি। মানুষের কল্যাণে যা কিছু ভালো, তা ফ্যাশনের আওতায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা অনুপেক্ষনীয়।
ফন্ডারি ফরটি সেভেনের উদ্দেশ্য আফ্রিকার সংঘাত ও হত্যার বদলে মরণাস্ত্রকে জুয়েলারি ও অ্যাকসেসরিজে পরিণত করা। যেগুলোর বিক্রিত অর্থ জমা হয় প্রতিষ্ঠানটির তহবিলে আরো অস্ত্র ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করার জন্য। এটি একেবারেই অলাভজনক বেসরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠান। যার তৈরি প্রতিটি পিস বলে শান্তিময় অসাধারণ একটি গল্প। এমনকি এত কান্ড ঘটে যাওয়া সত্ত্বেও এনিয়ে কোনো মন্তব্যে যাননি একে ফরটি সেভেনের ডিজাইনার মিখাইল কালাশনিকভ। অস্ত্র যখন পরিধানযোগ্য শিল্পে পরিণত হচ্ছে তখন কী-ই বা বলার থাকে।