Fashion Ornaments

বিভাময় মিনাকারি

গয়নার সৌন্দর্যে মিনাকারি। আলাদা এক মাত্রা। সোনা আর রুপার ঔজ্জ্বল্যে এটি যোগ করে নতুন দীপ্তি। অন্যান্য ধাতব অলংকারে এর যোগ ছড়ায় যে বিভা আর রঙ, তা থেকেও দৃষ্টি ফেরানো কঠিন

উৎপত্তি

উদ্ভব পারস্যে। তৃতীয় থেকে সপ্তম শতকে, সাসানিড রাজত্বকালে। সেখান থেকে মোঙ্গলদের হাত ধরে ভারত উপমহাদেশে। বিকাশ মোগল শাসনামলে, ষোলো শতকে। এ ক্ষেত্রে কৃতিত্বের দাবিদার আম্বারের (পরে জয়পুর) রাজা মান সিংয়ের। ষোলো শতকে তিনি লাহোর থেকে দক্ষ কারিগর নিয়ে এসেছিলেন মিনাকারি কাজের জন্য। প্রথমে এর ঠাঁই হয় রাজস্থানে। তবে তা পূর্ণতা পায় জয়পুরে। ক্রমে এটিই হয়ে ওঠে মিনাকারি কাজের কেন্দ্রস্থল। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশসহ অন্যান্য অঞ্চলে। আর ফ্যাশন ও স্টাইলে এর পরিগ্রহণ ঘটে আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের একটি সুসামঞ্জস্যপূর্ণ মিশেলে। মিনাকারির আজকের রূপ এই দীর্ঘ ধারাবাহিকতার ফল। তবে শুরুতে অলক্ষ্যে থাকা এই শিল্পকর্ম সবার নজরে আসে কুন্দন বা পাথরখচিত গয়নার সাপোর্ট হিসেবে ব্যবহৃত হবার পর। তবে গয়নার ক্ষেত্রে মিনাকারি যে বেশ পুরনো ও ব্যাপকভাবে গৃহীত একটি প্রযুক্তি, তাতে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়।

জয়পুরী মিনকারি গয়না

নামের উৎপত্তি ও প্রাক্রিয়া

ফার্সি মিনোর স্ত্রীবাচক শব্দ মিনা, যার অর্থ স্বর্গ। এই মিনো বা মিনা থেকেই মিনাকারি শব্দটির উদ্ভব। মিনাকে মনে করা হয় স্বর্গের নীল রঙ। তবে নীলেই এই শিল্প সীমাবদ্ধ থাকেনি। যোগ হয়েছে সবুজ, লাল, হলুদের মতো প্রগাঢ় সব রঙ। এটি মেটালের , তা হতে পারে সোনা, রুপা, তামার ওপর জটিল আর রঙিন প্যাটার্নে সজ্জিত করার একটি প্রক্রিয়া। রঙিন কাচের বা মূল্যবান পাথরের গুঁড়ার তৈরি বিশেষ রঙ দিয়ে সুকৌশলে নকশা তৈরি করা হয়। এখনকার কারিগররা অবশ্য অত্যাধুনিক বিভিন্ন পদ্ধতি এ কাজে ব্যবহার করে থাকেন। যেমন, স্বতন্ত্র রঙ পেতে মিনারেল অক্সাইড ব্যবহার করা হয়। কপার ও কোবাল্টের মতো মিনারেল পাউডারই ব্যবহৃত হয় বেশি। কারণ, এসব খনিজ উপাদান সহজেই ছাঁচে ফেলা যায় এবং এগুলো বেশ কালারফুল হয়।

মিনাকারি গয়না ও তৈজস

বাজারে বিভিন্ন ধরনের মিনাকারির গয়না পাওয়া যায়। এ ছাড়া মন্দিরের আসন, গয়নার বাক্স, চাবির রিং, বাটি, বিভিন্ন অভিনব শৌখিন উপকরণ, এমনকি কাটলারি প্রডাক্টও পাওয়া যায়। যদিও মিনাকারি সোনা, রুপা, তামার ওপরই বেশি করা হয়ে থাকে। তবে সোনায় বেশি ব্যবহৃত। এটি এনামেলকে বেশ ভালোভাবে ধারণ করতে পারে এবং এতে মিনাকারি দীর্ঘস্থায়ী হয়। সোনার উজ্জ্বলতায় এটি চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। রুপা এসেছে অনেক পরে, গয়না তো আছেই বক্স, বাটি, চামচ ও আর্ট পিস তৈরি করতে।

মিনাকারিতে ব্যবহৃত ধাতু

গোল্ড কন্ট্রোল অ্যাক্ট চালু হওয়ার পর হস্তশিল্পে সোনার বদলে অন্য যেকোনো ধাতু বেছে নিতে মিনাকারদের বাধ্য করা হয়। হোয়াইট মেটালের উদ্ভব মিনাকারি পণ্যকে আরও সাশ্রয়ী করেছে। তবে সব মেটালেরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন সোনা বা রুপার ওপর সহজে রঙ প্রয়োগ করা গেলেও শুধু সবুজ, হলুদ ও নীলের মতো রঙ এই দুটিতে টিকে থাকে বেশি। যেসব  ধাতু অল্প কিছুদিনেই  কালচে হয়ে পড়ে, সেগুলোয় মিনা অল্পতেই ম্লান হয়ে পড়ে।

মিনাকারির কারিগর ও তৈরি প্রক্রিয়া

মিনাকারির কারিগরদের বলা হয় মিনাকার। যাদের নৈপুণ্য  বংশানুক্রমিক। তবে আদিতে মিনাকাররা ছিলেন ক্ষত্রিয় গোষ্ঠীর সোনার বা সোনি জাতির অন্তর্ভুক্ত, যারা নিজেদের মিনাকার বা ভার্সা নামে পরিচয় দিতেন। এ-সম্পর্কিত জ্ঞান বা কৌশল বাইরের কারোর অর্জন করার ঘটনা ছিল বিরল। পরে এ নিয়ে তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকায় মিনাকারি কেবল ঐতিহ্যগত গয়না হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেনি। আধুনিক বিভিন্ন গয়না ও শৌখিন পণ্যেও এর প্রয়োগ ও রূপান্তর ঘটেছে। এই শিল্পকর্মের জন্য কারিগরি দক্ষতা প্রয়োজন। বিভিন্ন হাত ঘুরে মিনাকারি কাজের একটি পণ্য পূর্ণতা পায়। প্রথমে নকশাকার প্রাথমিক নকশা তৈরি করেন। এরপর আসে কালাকারের কাজ, যিনি  নকশা খোদাই করেন। খোদাই করা নকশা মিনাকার অনুসরণ করেন। এরপর পলিশের কাজ। হাতে রঙ করার বদলে এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে স্প্রের সাহায্যে মিনা করা হয়, যা স্প্রেমিনা হিসেবে পরিচিত। সোনার গয়নায় এটি বেশি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।

মিনাকারির ধরন

দু’ধরনের মিনাকারি বেশি প্রচলিত। একরঙ খুলা ও পাঁচরঙ্গি মিনা। প্রথমটিতে একটি রঙই ব্যবহার করা হয়। গাঢ় ও হালকা শেডের। পাঁচরঙ্গি মিনায় সাদা, ফ্যাকাশে নীল, গাঢ় নীল, গাঢ় সবুজ ও লাল পাঁচটি রঙ ব্যবহার করা হয়। এখন এই অন্যান্য রঙ এতে যোগ হয়েছে। তবে হালকা রঙের প্রাধান্যই বেশি। মোগল আমলে জনপ্রিয় ছিল সাদা, লাল ও সবুজ। এখনো জয়পুরে এই তিনটি রঙের প্রচলন ব্যাপক। এ কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত রঙ লাল, সবুজ ও নীল।

মোটিফ ও কালার

মিনাকারির তীর্থস্থান জয়পুর, অন্যান্য অঞ্চলেও এ নিয়ে সৃষ্টিশীল চর্চা চলছে। তবে প্রতিটি অঞ্চলেরই নিজস্বতা, কৌশল, স্টাইল, নকশা ও রঙ যোগ হয়। যেমন, লক্ষ্ণৌর রুপার ওপর সবুজ ও নীল এনামেল ব্যবহার করা হয়। বানারসের মিনাকারির  হলমার্ক  গোলাপি। মোটিফ পদ্ম। তবে আমাদের দেশে নতুন করে তেমন কিছু যোগ হয়নি। ভারতীয় বিভিন্ন অঞ্চলের প্রভাবই এখানকার কাজে বেশি দৃশ্যমান। প্রথম দিকে ফ্লোরাল ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর পাখি ও প্রাণীর প্যাটার্নই বেশি আঁকা হতো। পরে এতে যোগ হয় বিভিন্ন ফুলেল মোটিফের সঙ্গে জ্যামিতিক প্যাটার্ন। এখন এটাই বেশি ব্যবহৃত হয়। সর্বাধিক ব্যবহৃত প্যাটার্ন ময়ূর, হাতি, পদ্ম। আজকাল যথেষ্ট এক্সপেরিমেন্ট হলেও ক্ল্যাসিক নকশার আবেদনই বেশি। আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে নকশার মাঝে কুন্দন, বিভিন্ন রঙের পুঁতি এমনকি পান্না, রুবি, হীরা, মুক্তার মতো দামি  রত্নও ব্যবহৃত হয়।

রক্ষণাবেক্ষণ

এই বিশেষ কাজের গয়না মজবুত হয় এবং সময়ের ওপর এর ঔজ্জ্বল্য নির্ভরশীল। দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্বের জন্য এগুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি। সোনা, রুপার গয়না শুকনো কাপড় দিয়ে পরিষ্কার করে তুলায় মুড়ে রাখুন। যেসব গয়না তামার তৈরি, সেগুলো মিন ক্রিম দিয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে।

আমাদের দেশে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ ও ঢাকার মিনাকারি বেশ প্রসিদ্ধ। যেকোনো গয়নার দোকানেই এই গয়না পাওয়া যাবে। সোনা কিংবা রুপার। বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজে পিতলের মিনাকারি গয়নার কালেকশন মিলবে। এ ছাড়া ডিজাইনার কালেকশনে প্রায়শই মিনাকারি কাজের সোনা ও রুপার গয়না পাওয়া যায়। হোয়াইট মেটাল বা ইমিটেশনের গয়না তো বেশ সহজলভ্য। যেকোনো জুয়েলারিতে এটি মিলবে।

Ahmed Bubli

Ahmed Bubli

About Author

Believing that a good life is built on balance, this individual is dedicated to helping others discover what truly brings them happiness. Whether you're a busy parent, a driven professional, or a dedicated student, their insights aim to support you in living your best life.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You may also like

Fashion

Fasion Trends and Li Edelkoort the Culture Shock Special Report

Grursus mal suada faci lisis Lorem ipsum dolarorit ametion consectetur elit. a Vesti at bulum nec odio aea the dumm
Fashion

Trip Iqaluit Nunavut A Canadian Arctic City

Grursus mal suada faci lisis Lorem ipsum dolarorit ametion consectetur elit. a Vesti at bulum nec odio aea the dumm