শঙ্খ
![](https://beauty-pixel.com/wp-content/uploads/2023/09/45553_M_1.jpg)
যদিও ধর্মীয় উপচার। ধর্মীয় ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এখন বাঙালি সংস্কৃতির অংশ। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার বছরের ঐতিহ্য, স্মৃতি আর মিথ। সবকিছু মিলিয়ে শঙ্খ ব্যতিক্রমী ফ্যাশন অনুষঙ্গ
![](https://beauty-pixel.com/wp-content/uploads/2023/09/shankha-1.jpg)
হে পার্থসারথী! বাজাও বাজাও পাঞ্চজন্য শঙ্খ
চিত্তের অবসাদ দূর কর দূর
ভয়-ভীত জনে কর হে নিঃশঙ্ক ।।
( কাজী নজরুল ইসলাম)
![](https://beauty-pixel.com/wp-content/uploads/2023/09/shonkha-2.jpg)
![](https://beauty-pixel.com/wp-content/uploads/2023/09/shankha-3.jpg)
শঙ্খ নাদে ভয়-ভীতি বা মনের অবসাদ থেকে কতটুকু দূরে থাকা যায় তা হয়ত কারো জানা নেই। তবে বহুকাল ধরে এর ধ্বনি পবিত্রতার সাক্ষর বহন করে আসছে। শঙ্খের মাঙ্গলিক ধ্বনিতে খেলা হয় মন্দিরের দ্বার, শুরু হয় যে কোন শুভ কাজ। আর পূজার এই অপরিহার্য উপচার শঙ্খ থেকেই তৈরি হয় সধবা নারীর চিহ্ন শাঁখা। যা শান্তি ও মঙ্গলের প্রতীক।
![](https://beauty-pixel.com/wp-content/uploads/2023/09/Noksha.jpg)
![](https://beauty-pixel.com/wp-content/uploads/2023/09/sankha-pola-design.jpg)
মিথ ও প্রচলন
শঙ্খ আর শাঁখা নিয়ে প্রচলিত আছে নানা মিথ ও কিংবদন্তী। তবে এর ব্যবহার যে প্রাচীন তার প্রমান মেলে পৌরাণিক কাহিনীতে বিভিন্ন অনুষঙ্গের উল্লেখ আর ঐতিহাসিক উপকরণ প্রাপ্তিতে। ধারণা করা হয় খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে এর প্রচলন হয়। কিংবদন্তী আছে- দেবসভায় আয়োজিত এক আনন্দ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হন শিব ও দুর্গা। কোন গয়না পরে দুর্গা দেবসভার অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন তা নিয়ে বাধে বিপত্তি। উপায় না দেখে শিব শরনাপন্ন হন বিশ্বকর্মার আর বিশ্বকর্মা তাঁকে জানান, পৃথিবীর সব রত্নই এরমধ্যে দেবসভায় অংশগ্রহনকারী দেবীদের সাজে ব্যবহৃত হয়ে গেছে। শুধু সমুদ্রতলের শঙ্খই বাকি আছে। শিব যদি চান, তবে তা দিয়েই তিনি গয়না তৈরি করে দেবেন। শিব তাতেই সম্মত হলেন। দুর্গা শঙ্খের তৈরি গয়না পরেই দেবসভায় অংশ নিলেন। তাঁর সেই গয়নার ঔজ্জ্বল্যে ঢাকা পড়ে অন্যান্য মণিমাণিক্যের আভা। সেই থেকে গয়না হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে শাঁখা। যা অবশ্যই এঁয়ো নারীর হাতে থাকা চাই।
![](https://beauty-pixel.com/wp-content/uploads/2023/09/SHOWPICE.jpg)
![](https://beauty-pixel.com/wp-content/uploads/2023/09/ear-ring.jpg)
ফ্যাশনে শঙ্খ
তবে পৌরাণিক কাহিনী বা সনাতন ধর্মীয় আচার যা-ই থাক না কেন , সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি ধর্মীয় প্রথার বাইরে বাঙালী সংস্কৃতির একটি বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। হয়েছে সার্বজনীন। তাই হিন্দু নারীই নয়, অন্য ধর্মালম্বীরাও শঙ্খ, শাঁখা আর শঙ্খের তৈরি অন্যান্য গয়না ও তৈজসপত্র কেনেন। এতে শঙ্খের তৈরি গয়না পেয়েছে ভিন্ন মাত্রা। হয়ে উঠেছে ফ্যাশন অনুষঙ্গ।
![](https://beauty-pixel.com/wp-content/uploads/2023/09/CROMO-BIKASH.jpg)
![](https://beauty-pixel.com/wp-content/uploads/2023/09/cromo-bikash-2.jpg)
ক্রমবিকাশ
ধর্মীয় আচার আর নারীর গয়নার চাহিদা মেটাতে ক্রমে গড়ে উঠেছিল শঙ্খশিল্প। পুরাকীর্তি বিশেষজ্ঞদের মতে এর বিকাশ ঘটে খ্রিস্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে মহীশূর, হায়দ্রাবাদ, গুজরাট, কাথিয়াবার প্রভৃতি অঞ্চলে। পরবর্তীতে এই শিল্প সবচেয়ে বেশি প্রসারিত হয় বাংলাদেশের ঢাকা শহরের শাঁখারি বাজারকে কেন্দ্র করে। এবং কারিগরি দক্ষতা, নিপুণ কারুকাজ আর উৎকৃষ্ট মানের বিচারে একসময় ঢাকাই হয়ে ওঠে ভারতবর্ষে শঙ্খশিল্পের প্রাণকেন্দ্র। এখনো শাঁখারি বাজারেই পাওয়া যায় শঙ্খের তৈরি সেরা সব গয়না।
![](https://beauty-pixel.com/wp-content/uploads/2023/09/images.jpg)
![](https://beauty-pixel.com/wp-content/uploads/2023/09/terbinella.jpg)
শঙ্খের ধরণ
টারবিনেলা পাইরাম নামের বিরল প্রজাতির শঙ্খ থেকে তৈরি হয় এসব গয়না ও বাজাবার শাঁখ। ক্যালাসিয়াম কার্বনেটে তৈরি টারবিনেলা পাইরামের খোলক গয়না তৈরির জন্য উৎকৃষ্ট। তিতপুটি, রামেশ্বরী, পাটি, গারবেশি, ধলা, রায়াখাদ, মতি-ছালামত, কাচ্চাম্বর, জাডকি, কেলাবার, তিকৌড়ি, দোয়ানি, দুয়ানাপাটি, আলাবিলা ইত্যাদি শঙ্খ ব্যবহৃত হয় শাঁখা ও অন্যান্য গয়না তৈরিতে।
![](https://beauty-pixel.com/wp-content/uploads/2023/09/mith-22-1.jpeg)
![](https://beauty-pixel.com/wp-content/uploads/2023/09/english-panch-1.jpg)
শঙ্খের গয়না
শঙ্খের তৈরি গয়নার মধ্যে শাঁখার চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। কেবল ধর্মীয় চেতনা নয়, ফ্যাশন অনুষঙ্গ হিসেবেই এটি এখন বেশি বিক্রি হয়। বিচিত্র সব নামে বিভিন্ন সময়ে শাঁখার নামকরণ হয়- প্রাচীন যুগে গাড়া, মধ্যযুগে সাদাবালা, আউলাকেশী, পাঁচদানা, তিনদানা, বাচ্চাদার, সাতকানা আর পরবর্তী সময়ে সোনা বাঁধানো, পানবোট, জলফাঁস, টালি, সতীলক্ষী, দানাদার, ইংলিশপ্যাঁচ, ভেড়াশঙ্খ, চিত্তরঞ্জন, শিকলি বালা ইত্যাদি। পূর্ণবয়স্ক একটি টারবিনেলা পাইরাম থেকে কমপক্ষে চারটি শাঁখা তৈরি করা যায়। একজন শঙ্খশিল্পীকে মোট বারোটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয় একটি মাত্র শাঁখা তৈরিতে। এখন আর শাঁখের করাত তেমন ব্যবহৃত হয়না। মেশিনেই গোল করে কাটা হয় শঙ্খবলয়। একসময় এই শঙ্খবলয় ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি করা হতো। তবে এখন শুধু দেশেই বিক্রি হয়। এগুলো বিশেষ প্রক্রিয়ায় পরিষ্কার করে ভেতর ও বাইরের দিক ঘষে মসৃন করা হয়। এরপর এগুলো চলে যায় নকশাকারের কাছে ।
![](https://beauty-pixel.com/wp-content/uploads/2023/09/ring-2.jpg)
![](https://beauty-pixel.com/wp-content/uploads/2023/09/sankha-pola.jpg)
![](https://beauty-pixel.com/wp-content/uploads/2023/09/lokate.jpg)
নকশা
নকশাকার এতে ফুটিয়ে তোলেন লতাপাকা, ফুল, মাছ, পাখিসহ বিভিন্ন মোটিফ । ক্রেতারা নিজের পছন্দ মতো নকশা করিয়ে নিতে পারেন। যারা সোনা, রুপা বা অন্য কোন ধাতুতে শাঁখা বাঁধাই করতে চান তাদের যেতে হবে স্বর্ণকারের কাছে। এসব শাঁখার মধ্যে হাঁসমুখ, মকরমুখ, ময়ূরমুখ শাঁখার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এখনকার শাঁখার নকশায় এসেছে বেশ পরিবর্তন। তবে পুরনো নকশার কদর এখনো কম নয়। ক্রেতাদের চাহিদানুসারে পুরনো আর নতুনের মিশেলেও নকশা করা হয়। কেবল শাঁখা নয় শঙ্খের তৈরি অন্যান্য গয়নার চাহিদাও কম নয়। ব্রেসলেট, খোঁপার কাঁটা, মালা, দুল, ব্রুশ, বোতাম, ঘড়ির চেন, আংটিসহ শঙ্খের তৈরি বিভিন্ন গয়নারও বেশ কদর রয়েছে। এখনকার গয়নার ডিজাইন করা হয় চলতি ট্রেন্ড মেনেই। ক্রেতার পছন্দ ও রুচি অনুযায়ী শাঁখা ও শঙ্খজাত গয়নার নকশা করা হয়। তাই ধীরে ধীরে এর চাহিদাও বাড়ছে। তবে নিজের পছন্দ মতো গয়নার নকশা বা ডিজাইন করিয়ে নিতে চাইলে কয়েক দিন আগে অর্ডার দিতে হয়। শাঁখার জন্য দু’দিন আগে দিলেও চলে। কিন্তু পূজার সময় কাজের চাপ বেশি থাকে বলে বেশ কয়েক দিন আগেই যে কোন গয়নার অর্ডার দিতে হয়।
![](https://beauty-pixel.com/wp-content/uploads/2023/09/SHOWPICE-2.jpg)
![](https://beauty-pixel.com/wp-content/uploads/2023/09/Carved_Conch.jpg)
রয়েছে আতরদানি, পেপারওয়েট, কলম ইত্যাদি শঙ্খের তৈরি বিভিন্ন তৈজসপত্র। এসব জিনিসের ওপর বিচিত্র সব নকশা ফুটিয়ে তোরা হয়। এছাড়া ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত জলশঙ্খ ও বাদ্যশঙ্খের গায়েও নকশা করা হয়। বিভিন্ন দেব-দেবীর নকশা এসব শঙ্খে নিপুণ করে ফুটিয়ে তোলা হয়। এসব নকশা করা প্রাতিটি পণ্যই কিন্তু আমাদের কারুশিল্পের বিশেষ উপাদান।
![](https://beauty-pixel.com/wp-content/uploads/2023/09/shankha-in-f.jpg)
![](https://beauty-pixel.com/wp-content/uploads/2023/09/shankha-in-fashion-2.jpg)
তবে প্রয়োজনীয় সরকারি ও সামাজিক পৃষ্ঠপোশকতার অভাবে চাহিদা থাকা সত্তেও ধ্বংস হতে চলেছে হাজার বছরের এই শঙ্খশিল্প। শাঁখারি বাজারে প্রায়ই পর্যটকদের আনাগোনা দেখা যায়। শঙ্খশিল্প এবং এর তৈরি গয়না ও তৈজসপত্রের প্রতি তাদের বেশ আগ্রহও আছে। কিন্তু পর্যাপ্ত উদ্যোগ না থাকায় এই শিল্পটিকে বহির্বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে আমরা ব্যর্থ। তাই যথেষ্ট চাহিদা ও সম্ভাবনা থাকলেও শঙ্খশিল্পের অতীতের সেই জৌলুস ফিরিয়ে আনা যাচ্ছেনা। তবে ঐতিহ্যবাহী এই শঙ্খশিল্প ও শঙ্খজাত গয়নার ঔজ্জ্বল্যে আমাদের ফ্যাশন জগৎ সমৃদ্ধ হতে পারে প্রয়োজনীয় সরকারি সহযোগিতা পেলে। শুধু তাই নয়, ঝিমিয়ে পড়া ও হতাশ শঙ্খশিল্পদের মধ্যে আবারো কর্মচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব।