Heritage Lifestyle

পঞ্চগড়ের ভিতরগড়

ভিতরগড়

হিমালয়ের আদুরে কন্যা পঞ্চগড়। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি। বাংলদেশের উত্তর-পশ্চিমের এই জেলাটি তেইশটি নদী দিয়ে জড়ানো। এখান থেকে থেকে দেখা মেলে ভারতের অপূর্ব পাহাড় কাঞ্চনজঙ্ঘার। পাহাড়ের কোল ঘেঁষা এই অঞ্চল ইতিহাস ঐতিহ্যের বাহক ও সাক্ষী হয়ে রয়েছে।

নামকরণ

এখনকার মতো অতীতেও প্রাচীন এই জনপদটি ছিলো সীমান্ত অঞ্চল। এই অঞ্চলের পাশেই ছিলো মগধ, গৌড়, নেপাল, ভূটান, সিকিম ও আসাম রাজ্যের সীমান্ত। তাও সেই প্রাচীন ও মধ্য যুগে। কামরূপ, কুচবিহার, কামতা, গৌড় রাজ্যেসহ বিভিন্ন রাজ্যে ও অঙ্গ রাজ্যের রাজা, বাদশা, সুবাদার ও ভূ-স্বামীদের দ্বারা শাসিত ও নিয়ন্ত্রণাধিন ছিলো। ধারণা করা হয় রাজা শালিবাহন, রাজা পৃথু ও রাজা জল্লেশ পঞ্চগড়ে সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে তুলেছিলেন। তবে পৃথু রাজের অবদান ও তার নাম জড়িয়ে নানান কিংবদন্তীই এই অঞ্চলে বেশি প্রচলিত।

প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ‘পঞ্চনগরী’ থেকে পঞ্চগড়ের নাম এসেছে এমনটাই কেউ কেউ মনে করেন। তবে ‘পঞ্চ’ বা পাঁচ গড়ের সমাহার থেকে অঞ্চলটির নাম পঞ্চলের থেকে পঞ্চগড় হয়েছে এধারণাটিই বেশি প্রচলিত। কিন্তু সবই অনুমান নির্ভর। নামকরণের এইসব ধারণার মধ্যে বহুল প্রচলিত হলো এখানে পাঁচটি গড়ের সুস্পষ্ট অবস্থানের কারণেই  ‘পঞ্চগড়’ নাম হয়েছে। এই পাঁচটি গড় হলো- ভিতরগড়, মিরগড়, রাজগড়, হোসেনগড় ও দেবনগড়। এসব গড়ের অস্তিত্ব এখনো নানান স্থাপনার ভগ্নাংশ জানান দিচ্ছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যতো দেখতে যাবেনই, সাথে দেখে আসতে পারেন ইতিহাস সমৃদ্ধ এসব গড়।

ভিতরগড় দুর্গনগরীর ভগ্নাংশ

ভিতরগড়ের অবস্থান

জেলা শহর থেকে উত্তর-পূর্বে ১৬ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে হবে। আমরখানা ইউনিয়নে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় প্রায় ২৫ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ভিতরগড়। এই গড় এখন দু-টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে উভয় বাংলায়। এর বাইরের আবেষ্টনীর উত্তর এবং পূর্ব ও পশ্চিম দেয়ালের উত্তরাংশ এখন ওপারের জলপাইগুড়ির।

প্রথম আবেষ্টনী

পুরনো হিমালয় পর্বতমালার পায়ের কাছে সমতল ভূমিতে তরাই অঞ্চলে এশিয়ার সবচেয়ে বড় দুর্গনগরী বাংলাদেশের পঞ্চগড়। এই পঞ্চগড়ের একটি গড় ভিতরগড়। এর উপরিভাগে গাঢ় ধূসর বা কালো রঙের বেলে মাটি। ভিতরগড়ের পানি সরবরাহের প্রধান উৎস ছিলো ভারতের জলপাইগুড়ি থেকে বয়ে আসা তালমা ও কুড়ম নদী। ভিতরগড়ে গেলে প্রথমেই যে বিষয়টি চোখে পড়ে তা হলো এই দুর্গনগরীটি চারটি আবেষ্টনী মিলে গঠিত হয়েছে। আবেষ্টনীগুলো একটি অপরটির ভিতরে অবস্থিত। দেয়ালগুলে পুরোপুরি ইটে নির্মিত। দেয়ালগুলো মজবুত করে তোলার জন্য বাইরের দিকে দেয়ালের সাথে আয়তাকার বুরুজ যুক্ত করা হয়েছে। সম্ভবত ভেতরের আবেষ্টনীর উত্তর পূর্বাংশে রাজবাড়ি ছিলো।

এই আবেষ্টনীর ভেতর চোখ জুড়াবে দুটি প্রাচীন দিঘি।আবেষ্টনীর ভেতর আবিষ্কৃত হয়ছে একটি কুরুশাকৃতির মন্দির যার পূর্ব-পশ্চিম উভয় দিকে স্তম্ভ বিশিষ্ট বারান্দা রয়েছে। এই মন্দিরের একবারে মাঝখানে আছে একটি কেন্দ্রীয় কক্ষ। এই কক্ষকে ঘিরে আছে আরো চারটি কক্ষ। খনন কাজ চালানোর সময় মন্দির স্থাপত্যে ব্যবহৃত ইট ও ত্রিকোনাকৃতির পাথরের খন্ড পাওয়া গেছে। সেগুলো ছিলো বিচিত্র নকশা কাটা। স্থাপত্যের নিচের দিকের স্তরে আরো পাওয়া গেছে লাল ও ধূসর রঙের নানান নকশা কাটা মাটির পাত্রের ভাঙ্গা অংশ, লোহা ও তামার তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কালো পাথরের তৈরি  মনসা মূর্তির ভগ্নাংশ। এটিও আবেষ্টনীর ভেতরেই পাওয়া গেছে। পঞ্চগড় মহিলা কলেজের রকস মিউজিয়ামে মূর্তিটি সংরক্ষিত আছে।

মহারাজার দিঘি। ধারণা করা হয় এখানেই পৃথুরাজা পরিবার-পরিজনসহ আত্মহত্যা করেন।

দ্বিতীয় আবেষ্টনী ও মহারাজার দিঘি

এইতো গেলো প্রথম আবেষ্টনী। প্রথম আবেষ্টনী আর মহারাজার দিঘিসহ মোট পাঁচটি দিঘিকে ঘিরে আছে দ্বিতীয় আবেষ্টনী। এর দেয়াল পুরোটাই ইটের তৈরি। ‍প্রথমটির মতো এই আবেষ্টনীর দেয়ালের বাইরেও আয়তকার বুরুজ সংযোজিত রয়েছে। এই আবেষ্টনীর দেয়ালগুলোর বাইরের চারদিকে গভীর পরিখা রয়েছে। বর্ষায় পরিখাগেুলো পানিতে ভরা থাকে। জনশ্রুতি আছে দ্বিতীয় আবেষ্টনীর উত্তরে কালদুয়ার ও দক্ষিণে যমদুয়ার নামে দু’টি প্রবেশদ্বার ছিলো। মহারাজার দিঘি, ফুলপুকুরী, কোদালধোয়া, মলানীদিঘি ও সিঙ্গারী দিঘি নামের পাঁচটি দিঘি এখনেো তাদের স্নিগ্ধ রূপ নিয়ে বিরাজমান। সবচেয়ে বড়টি হলো মহারাজার দিঘি। রাজপ্রসাদের একবারে কাছের এই দিঘিটি প্রায় ৫৩ একর জায়গা জুড়ে। দিঘিটির চারদিকের ইট ও মাটির তৈরি ছ’মিটার উঁচু পাড় দিয়ে ঘেরা। গভীরতা প্রায় নয় মিটার। তেমন কোনো জলজ উদ্ভিদ না থকাতে পানি এখনো বেশ স্বচ্ছ। আছে দশটি ইট বাঁধানো ঘাট। এসব ঘাটে একসময় রাজ পরিবারের সদস্যরা স্নান করতেন। কালের আবর্তে রাজা, রাজপরিবার হারিয়ে গেলেও ঘাটগুলো সেসব দিনের কথা আর কাহিনীর সাক্ষী হয়ে আছে। পৃথু রাজাই এই দিঘি খনন করেন বলে জনশ্রুতি আছে। স্থানীয় লোকজনের মুখে শোনা যায় একবার পৃথু রাজা কিচক নামক অসাধু ও নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠীর আক্রমনের শিকার হন। নিজের পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষা করতে পরিবার-পরিজনসহ দিঘির জলে আত্মহত্যা করেন। এমনকি তাঁর রক্ষীবাহিনীও তাঁকে অনুসরণ করে। অবসান ঘটে পৃথু রাজার রাজত্বের। এখন প্রতিবছর এই মহারাজার দিঘির পাড়ে মেলা বসে। একসময় ভারতীয় অধিবাসীরাও এই মেলায় যোগ দিতো।

স্তম্ভ বিশিষ্ট স্তুপের পূর্বাংশ।

তৃতীয় ও চতুর্থ আবেষ্টনী

দ্বিতীয় আবেষ্টনীর বাইরের দিকে তৃতীয় আবেষ্টনী। এই আবেষ্টনীর সব দেয়ালই মাটির তৈরি। তবে উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালের মাঝামাঝি অংশ ইটের। এই আবেষ্টনীর পশ্চিম দিক ছাড়া আর সব দিকের দেয়ালের বাইরে গভীর পরিখা আছে। পশ্চিম দেয়ালের বাইরে দিয়ে তালমা নদী প্রবাহিত হওয়ায় পরিখা খননের প্রয়োজন হয়নি। এই তালমা নদী ও শালমারা নদীতে বাঁধ নির্মাণ করে ভিতরগড় দুর্গনগরীর মধ্যে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়। এই তৃতীয় আবেষ্টনীর ভিতরে বাঘপুকুরী,ঝলঝলি ও মলানী নামের তিনটি প্রাচীন দিঘি আছে।

চতুর্থ আবেষ্টনীর দেয়ালের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি ছোট দুর্গ তৈরি হয় যা ধুমগড় নামে পরিচিত। এখানেও দেয়ালের বাইরের দিকে পনেরো মিটার চওড়া পরিখা দিয়ে ঘেরা।

পৃথু রাজা ও ভিতরগড়

পৃথু রাজা কিংবা তার রাজ্য ভিতরগড় সম্বন্ধে বাংলার ইতিহাসে খুব কমই উল্লেখ আছে। ষোলো শতকে সম্ভবত ভিতরগড় ছিল কামতা-কোচ রাজ্যের অংশ যা বিশ্বসিংহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এছাড়া একসময় এটি সুলতানী বাংলার অন্তর্গত হয়। আরও পূর্বে সুলতান মুঘিসউদ্দীন কর্তৃক কামরূপ অভিযানের সময়ে এ অঞ্চল বোড়ো, কোচ ও মেচ গোষ্ঠীর বারো ভূঁইয়াদের শাসনের অন্তর্গত ছিল। ইতিহাস বিজড়িত এই অঞ্চল পৃথু রাজার সময়ে যে বেশ সমৃদ্ধ হয়েছিলো তাতে সন্ধেহ নেই।

ধারনা করা হয় ভিতরগড় পৃথু রাজার রাজধানী ছিলো। ইতিহাসে তাঁর নাম তেমন মর্যাদা না পেলেও স্থানীয়দের কাছে তিনি মহারাজা হিসেবেই পরিচিত। তাঁকে নিয়ে আছে নানান কীংবদন্তী। তাঁর নাম নিয়েও আছে কিছুটা বিভ্রান্তী। কে এই পৃথু রাজা? কোথা থেকে তিনি এসেছিলেন? এই ভিতরগড়ে কারা বসবাস করতো? এর উৎপত্তি বা বিলুপ্তির পেছনে কী কারণই বা ছিলো? এসব প্রশ্নের উত্তর এখনি দেয়া সম্ভব না হলেও, উৎখননকালে প্রাপ্ত নিদর্শনের আলোকে ধরে নেয়া যায় যে ছয় শতকের শেষে বা সাত শতকের শুরুতে ভিতরগড় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবেই।  ততকালীর বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও এই রাজ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো। এর কারণ হিসেবে ধরা হয় প্রাচীন বাণিজ্য সড়ুক ও নদীপথের উপর এর অবস্থানকে। অবস্থানগত কারণে এই অঞ্চলের অধিবাসীরা সম্ভবত নেপাল, ভূটান, সিকিম, আসাম, কোচবিহার, পশ্চিম ও দক্ষিণ বাংলার সাথে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বজায় রাখতে পেরেছিলো।

বাংলাদেশের সুন্দর এই প্রত্নতাত্তিক ও ইতিহাস সমৃদ্ধ এই অঞ্চল ভ্রমন ও ইতিহাসপ্রেমিদের আনন্দ দেবে। আর নানান কীংবদন্তী দূর অতীত নিয়ে ভাবনার খোরাক জোগাবে।

Avatar

admin57

About Author

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *