কোলাজেন

শুধু বাহ্যিক চর্চাই নয়, পাশাপাশি শরীরের ভেতরের দিক থেকেও নিজেকে সুন্দর রাখার রসদ যোগানো চাই। চাই যথাযথ খাবার গ্রহনের মাধ্যমে ত্বক, চুল, নখসহ শরীরের বাহ্যিক অঙ্গগুলো ঠিক রাখার চেষ্টা । কোলাজেন হতে পারে এই প্রচেষ্টার যুতসই উপায়

বয়সের ছাপ, বলিরেখা, মুখত্বকে বিভিন্ন ধরনের দাগ এগুলো সৌন্দর্যপ্রিয় নারীদের স্বাধারণ একটি সমস্যা। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানব দেহে বাহ্যিকভাবে তার প্রকাশ ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বুড়িয়ে যেতে কেই-বা চায়। সবাই চান নিজের সৌন্দর্য ধরে রাখতে। আর তার জন্য সৌন্দর্য চর্চার নানান উপায় ও ট্রিটমেন্ট সৌন্দর্যপ্রিয়রা বেছে নেন। তবে বাহ্যিক চর্চার পাশাপাশি শরীরের ভেতরের দিক থেকেও নিজেকে সুন্দর রাখার রসদ যোগানো চাই। অর্থাৎ যথাযথ খাবার গ্রহনের মাধ্যমে ত্বক, চুল, নখসহ শরীরের বাহ্যিক অঙ্গগুলো ঠিক রাখার চেষ্টা করতে হবে।

বলিরেখা, দাগ, চুল ঝরে যাওয়া এমন সমস্যাগুলোর জন্য দায়ী কোলাজেন। শরীরে কোলাজেনের মাত্রা কমে গেলে এসব সমস্যা দেখা দেয়। শরীরে যেসব প্রোটিনের আধিক্য রয়েছে কোলোজেন তাদের একটি। এটি ত্বক, চুল ও নখের একটি বড় অংশ তৈরি করে। টেকনিক্যালি এটি একটি পলিপেপটাইড, কোলাজেন পোলিন ও গ্লিসিনের মতো অ্যামিনো অ্যাসিডের মিশ্রণ যা শরীরের সব সংযোগ টিস্যুতে রয়েছে।


বিভিন্ন ক্রিম ও শ্যাম্পুর ল্যাবেলে কোলাজেন সমৃদ্ধ এবং এর উপকারীতার কথা উল্লেখ থাকে। আসলে প্রকৃত উপকার হয় অভ্যন্তরীরভাবে, একটি সাময়িক নিরাময় পদ্ধতি ধেতে নয়। ত্বকের ইলাস্টিসিটি বজায় রাখা, চুলের দৃঢ়তা ও সংযোগ টিস্যুর দৃঢ়তার জন্য দায়ী এই কোলাজেন। এগুলোকে ঠিকঠাক রাখার ক্ষমতা রাখে এটি। শরীরের স্বাভাবিক কোলাজেন উৎপাদন বয়সের সাথে সাথে ও আধুনিক জীবনধারার কারণে অবনতি ঘটে এবং ত্বকের নানান সমস্যা শুরু হয়। যেমন ত্বকের শুষ্কতা একটি সাধারণ সমস্যা যা কোলাজেন সাপলিমেন্ট দিয়ে পূরণ করা যায়। আমেরিকান একাডেমি অব ডার্মাটোলজির দেয়া তথ্য অনুযায়ী বেশ কিছু কারণ রয়েছে ত্বকের শুষ্কতার জন্য। এর মধ্যে পরিবেশ, বার্ধক্য ও জীবনযাপন পদ্ধতিও অন্তর্ভূক্ত। তাই জীবনযাপন পদ্ধতিতে বদল ঘটালে ও স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গ্রহন করতে পারলে কোলাজেন ঠিক থাকবে। এছাড়া এটি ত্বকের প্রতিরোধ ক্ষমতা ও ইলাস্টিসিটি প্রদান করার পাশাপাশি মৃত ত্বককোষ প্রতিস্থাপনে সাহায্য করে। একটি বিষয় মনে রাখা জরুরি বয়সজনিত কোলাজেনের অবনতি এড়ানো যায় না। বয়সের সঙ্গে সেঙ্গে এর উৎপাদন স্বাভাবিকভাবেই ধীরেধীরে কমতে থাকে। তাই এর মাত্রা যাতে শরীরে ঠিকঠাক শরীরে বিদ্ধমান থাকে সেই চেষ্টা করাটা জরুরী।


কোলাজেন লেবেল বাড়াতে পারলে এটি ত্বকের দৃঢ়তা ও মসৃণতা বৃদ্ধি এবং স্বাভাবিকভাবে ত্বককোষ তারুণ্যদীপ্ত ও মেরামত করে নিতে সাহায্য করতে পারে। অ্যান্টি-এজিং ক্ষমতা সমৃদ্ধ কোলাজেন পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ২.৫০- ০৫ গ্রাম কোলাজেন হাইড্রোলাইসিস ৩৫-৫৫ বছর বয়স্কা মহিলারা দিনে একবার করে আট সপ্তাহ ব্যবহার করলে ত্বকের ইলাস্টিসিটি, ময়শ্চার, শুষ্কতা ও রুক্ষতা কোনো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ছাড়া ছাড়াই উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নতি করে। তাই কোলাজেনের মাত্রা ঠিক রাখার প্রক্রিয়া এখন প্রাকৃতিক ত্বকের যত্নের সেরা উপায়ে পরিণত হয়েছে।


এটি বন্ধ লোপকূপ ও স্ট্রেচমার্ক সারিয়ে তোলে। কোলাজেন ক্ষয়ের ফলে যখর ত্বক তার ইলাস্টিসিটি হারায় তখন আরেকটি পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, সেলুলিটি বা লোমকূপ দৃশ্যমান হয়। মুখত্বক পাতলা হওয়ার কারণে সেলুলিটি আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। আর ত্বকের নিচে কি ঘটছে তা গোপন থাকে না। কোলাজেনের সাহায্যে ত্বকের ইলাস্টিসিটি ইমপ্রুভ করিয়ে নিলে তা ত্বকের ভাঁজ কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া এর অভাবে নখ ভঙ্গুর ও খসখসে হতে পারে। কোলাজেন প্রোটিন হলো নখ, চুল ও ত্বকের বিল্ডিং ব্লক। তাই খাদ্য তালিকায় কোলাজেন সমৃদ্ধ খাবার রাখুন এতে নখ দৃঢ় থাকবে ও চুল ঝরে যাওয়া থেকে রক্ষা করবে।


মানুষের শরীরে কমপক্ষে ষোলটি বিভিন্ন ধরণের কোলাজেন রয়েছে। এগুলো কোলাজেন টাইপ- ১,২,৩,৫ ও ১০। টাইপ-১ আমাদের শরীরের এ পর্যন্ত সব চেয়ে শক্তিশালী ও পরিমানে বেশি থাকা কোলাজেন। এ ধরনের কোলাজেন ক্ষত নিরাময়, ত্বকের ইলাস্টিসিটি ঠিক রাখা ও ইলাস্টিক কোয়ালিটি বজায় রাখা এবং টিস্যুগুলো পাশাপাশি রাখতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
টাইপ-৩ কোলাজেন জালের মতো ফাইবারে তৈরি এবং এর একটি প্রধান উপাদান এক্সট্রাসেলুলার ম্যাট্রিক্স যা আমাদের অর্গান ও স্কিন তৈরি করে। টাইপ-৪ কোলাজেন মৌলিক ল্যামিনা বা ল্যামিনার ভিত্তি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মৌলিক ল্যামিনা ত্বকের উপরের স্তরে ও গভীরতম স্তরে পাওয়া যায়। এগুলো জেলের মতো বা তরলের একটি পাতলা স্তর। যা টিস্যুর উপর সুরক্ষা দেয়াল তৈরি করে। টাইপ-৫ এই ধরনের কোলাজেন কোষের বাইরের স্তর তৈরির জন্য প্রয়োজন হয়। যেমন, চুলের টিস্যু গঠনে এটি প্রয়োজন হয়।


অনেকেইরই জানা আছে ভিটামিন সি ত্বকের জন্য ভালো। এর কারণটা হচ্ছে কোলাজেন তৈরিতে ভিটামিন সি’র মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে বায়ু, পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করা টক্সিন থেকে রক্ষা করে। এই টক্সিন কোলাজেন ভেঙ্গে ফেলে ও ত্বকের অভ্যন্তরীন লেয়ার ক্ষতিগ্রস্থ করতে অবদান রাখে। তাই সজীব সুন্দর ত্বকের জন্য প্রয়োজ ভিটামিন সি। প্রতিদিন প্রচুর ফল ও ফলের রস খেতে হবে। বিশেষ করে সিট্রাস ফল, যেমন- মুসাম্বি, কমলালেবু। এছাড়া পালং শাক, কাঁচামরিচেও প্রচুর ভিটামিন সি রয়েছে।

কোলাজেন বাড়াতে যদি একটি মাত্র খাবার খেতে চান সেটি হলো হাড়ের ঝোল বা স্যুপ। খাবারটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অন্যান্য পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ যা কোলাজেন সংশ্লেষণ বা সমন্বয়ে সাহায্য করে। হাড়ের ঝোল আসলে কোলাজেনের বায়োঅ্যাবঅ্যাবল ফর্ম যা শরীর সরাসরি ব্যবহার করতে পারে। গরু বা খাসির হাড় দীর্ঘসময় ধরে রান্না করে নিলে হাড় থেকে কোলাজেন বেরিয়ে আসবে এবং পুষ্টি সমৃদ্ধ ঝোল পাওয়া যাবে। গরুর হাড়ের ঝোল টাইপ-১ কোলাজেন সমৃদ্ধ আর মুরগীর হাড়ে রয়েছে টাইপ-২ কোলাজেন। এগুলো ত্বকের স্বাস্থের জন্য সেরা।

সবুজ শাক-সবজি শরীরের রোগ-প্রতিরোধের জন্য সবচেয়ে পুষ্টি-সমৃদ্ধ খাবার। কিন্তু এটি কোলাজেনের ভাঙ্গন প্রতিরোধের একটি শক্তিশালী উপায়ও হতে পারে। সবুজ শাকে রয়েছে ক্লোরোফিল। আর গবেষণায় দেখা গেছে ক্লেরোফিল গ্রহনকারীদের ত্বকে কোলাজেন উল্লেখযোগ্য পরিমানে বৃদ্ধি পায়।
মুরগীর ডিম কোলাজেনের আরেকটি ভালো উৎস। ডিমের কুসুম ও ডিমের খোসার ঝিল্লিতে কোলাজেন রয়েছে। এছাড়া ডিম সালফার সমৃদ্ধ খনিজের একটি ভালো উৎস কোলাজেন উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয়।
এছাড়া সয়া প্রোডাক্ট, লাল ফল ও শাক-সবজি, আলুবোখারা, বেরি, ওমেগা অ্যাসিড, চকোলেট, অ্যাভাকাডো, মিষ্টি কুমড়ার বিচি, রসুন এসব খাবার কোলাজেন বৃদ্ধিতে ও কোলাজেন রক্ষা করতে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে।
খাবারের মাধ্যমে শরীরের কোলাজেনের বৃদ্ধি ও রক্ষার চেষ্টা করাটাই ভালো। এতে অকাল বার্ধক্য, একটু বেশি বয়সেও নিজেকে তারুণ্যদীপ্ত দেখানো, নিখুঁত ত্বক, দৃঢ় আর মসৃণ চুল পাওয়াটা অনেক সহজতর হবে।